২.ভাগবতের আলোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য -পর্ব ০২ বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডে প্রাণী আছে কিনা? (𝔸𝕣𝕖 𝕥𝕙𝕖𝕣𝕖 𝕒𝕟𝕪 𝕝𝕚𝕗𝕖 𝕚𝕟 𝕕𝕖𝕗𝕗𝕖𝕣𝕖𝕟𝕥 𝕌𝕟𝕚𝕧𝕖𝕣𝕤𝕖) বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের সৌর জগতের মত মহাবিশ্বে আরো অসংখ্য সৌর জগত রহিয়াছে । সে সকল স্থানে বুদ্ধিমান জীব থাকা সম্ভব । এ ব্যাপারে ভাগবত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে অনন্ত কোটি জীব রহিয়াছে । তবে বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডের পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন সেজন্য্ সে সকল স্থানে বিভিন্ন প্রকারের জীব রহিয়াছে । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে এ মহাবিশ্বে ৮৪ লক্ষ রকমের জীব রয়েছে । মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহে মানুষ আছেঃ-
নভো দদাতি শ্বসতাং পদং যন্নিয়মাদদঃ ।
লোকং স্বদেহং তনুতে মহান্ সপ্তভিরাববৃতম্ ।। (ভাগবত ৩/২৯/৪৩)
অনুবাদ পরমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রণে আকাশ অন্তরীক্ষে বিভিন্ন গ্রহদের স্থান প্রদান করে, যেইখানে অসংখ্য প্র্রাণী বাস করে । তাঁহার পরম নয়ন্ত্রনে সমগ্র ব্রহ্মান্ডের বিরাট শরীর সপ্ত আবরণসহ বিস্তৃত বিশ্বব্রহ্মান্ডের আবরণের ধারণা হয় । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে সমগ্র ব্রহ্মান্ডের অসংখ্য গ্রহে অসংখ্য প্রাণী বাস করে এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের ৭ টি আবরণ আছে । সে বিষয়টি উল্লেখ করা হইয়াছে । বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের ৭ টি আবরণ আছে । অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে অনন্ত কোটি জীব আছে, সে সকল ব্রহ্মান্ডে মানুষসহ সব ধরনের জীব আছে । সে সব ব্রহ্মান্ডের মানুষের ধর্ম কি ? তাদের জীবনযাত্রার মান কেমন ? তাহাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা ভাগবতে আছে । আমি সংক্ষেপে বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডের মানুষের বৈশিষ্ট্য কিছু আলোচনা করছি । বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডের জীবের বর্ণনা
ভাবয়ত্যেষ সত্ত্বেন লোকন্ বৈ লোকভাবনঃ ।
লীলাবতারানুরতো দেবতির্যঙ্ নরাদিষু ।। (ভাগবত ১/২/৩৪)
অনুবাদ এ ভাবে সমস্ত জগতের পতি দেবতা, মনুষ্য এবং পশু অধ্যুষিত সমস্ত গ্রহ লোকগুলি প্রতিপালন করেন । বিভিন্ন অবতারে তিনি তাঁহার লীলা-বিলাস করিয়া বিশুদ্ধ-সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হইয়াও জীবসমূহকে উদ্ধার করেন । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে অনন্ত কোটি জড় ব্রহ্মান্ড রয়েছে এবং প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে অসংখ্য গ্রহ রয়েছে । সেখানে অসংখ্য জীব প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিরাজ করছে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ছায়ারূপ প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে এবং প্রতিটি গ্রহে অবতরণ করেন । তিনি বিভিন্ন গ্রহে জীবদের মাঝে তাঁহার বৈদিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন, যাহাতে তাহারা চিন্ময় জগতে ফিরিয়া যাওয়ার যোগ্যতা লাভ করিতে পারে । ভগবাণ তাঁহার অপ্রাকৃত স্থিতির পরিবর্তন করেন না, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশে এবং বিভিন্ন সমাজে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন বলিয়া মনে হয় । প্রতিটি ব্রহ্মান্ড নিয়ন্ত্রনের জন্য কৃষ্ণ একজন প্রতিনিধি নির্ধারণ করিয়াছেন, তাঁহার নাম ব্রহ্মা । প্রত্যেক ব্রহ্মান্ডের সর্বোচ্চ গ্রহের নাম ব্রহ্মালোক বা সত্যলোক, সেই গ্রহে ব্রহ্মা বসবাস করেন । ব্রহ্মার ১ দিনকে উক্ত ব্রহ্মান্ডের ১ দিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়, বিভিন্ন ব্রহ্মান্ডের দিনের সময় উক্ত ব্রহ্মান্ডের আয়তন দ্বারা নির্ধারণ করা হয় । যেমন – আমাদের ব্রহ্মান্ড সবচেয়ে ছোট, এই ব্রহ্মান্ডের ১ দিন আমাদের পৃথিবীর হিসাবে ৪৩২ কোটি বছর সেরকম আমাদের পাশ্ববর্তী ব্রহ্মান্ডের আয়তন আমাদের চেয়ে সামান্য বড়, সেখানকার ব্রহ্মান্ডের ১ দিন ৪৩২ কোটি বছরের কিছু বেশী হইবে । এভাবে প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ১ দিন অন্য ব্রহ্মান্ড থেকে আলাদা । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেক ব্রহ্মান্ডের ১ দিনে কৃষ্ণ একবার করে সেই ব্রহ্মান্ডে যান । আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে কৃষ্ণ আমাদের ব্রহ্মান্ডের পৃথিবী বা মর্ত্যলোক নামক গ্রহে আসিয়েছিলেন, তিনি পৃথিবীতে আবার ৮৬৪ কোটি বছর পর আসিবেন । ব্রহ্মার ১ দিনে কৃষ্ণ একবার সেই ব্রহ্মান্ডে যান ব্রহ্মার এক দিনে তিহোঁ একবার । অবতীর্ণ হঞা করেন প্রকট বিহার ।। (চৈতণ্য চরিতামৃত পাতা ১২৬ শ্লোক ৬) অনুবাদ ব্রহ্মার একদিনে একবার তিনি তাঁহার আপ্রাকৃত লীলা প্রকট করিবার জন্য এই জড় জগতে অবতীর্ণ হন । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মার ১ দিনে কৃষ্ণ সেই ব্রহ্মান্ডে একবার যান । এভাবে বিবেচনা করলে বোঝা যায় প্র্রতিটি ব্রহ্মান্ডে অসংখ্য মানুষ রহিয়াছে এবং সে সকল ব্রহ্মান্ডে সনাতন ধর্ম বর্তমান রয়েছে । অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে ও চিন্ময় জগতে বৈদিক ধর্ম বিদ্যমান ।এ জন্য এই ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম । ব্রহ্মান্ড সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের ধারণা (ℂ𝕠𝕟𝕔𝕖𝕡𝕥 𝕠𝕗 𝕊𝕔𝕚𝕖𝕟𝕥𝕚𝕤𝕥𝕤 𝔸𝕓𝕠𝕦𝕥 𝕌𝕟𝕚𝕧𝕖𝕣𝕤𝕖) ব্রহ্মান্ড বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট কোন ধারনা নাই, তারা বিশ্বব্রহ্মান্ডের মাঝে কিছু মসৃণ অঞ্চল দেখতে পান সেগুলিকে আমাদের মত সৌর জগত মনে করেন, এই মসৃণ অঞ্চলগুলি সৌর জগত সেটা সঠিক এবং ভাগবতের আলোকে এই মসৃণ অঞ্চলগুলিকে ব্রহ্মান্ডের অভ্যন্তরভাগ বলা হয় আর ইহার চতুর্দিকে যে অমসৃণ স্থান বিদ্যমান সেগুলি ব্রহ্মান্ডের আবরণ । বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মান্ড এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে কোন সুস্পস্ট পার্থক্য আবিষ্কার করতে পারে নাই । সেজন্য মহাবিশ্ব বিষয়ে তারা যে মতবাদগুলি আবিষ্কার করেছেন সেগুলি অসম্পূর্ণ এবং পরস্পর বিরোধি বলে মনে হয়, যা পরবর্তীতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি পর্বে আলোচনা করা হবে । ভাগবতে যেমন প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের বর্ণনা নির্দিষ্ট ভাবে করা হয়েছে বিজ্ঞানীরা সেভাবে আবিষ্কার করতে পারে নাই ।যেমন আমরা যে ব্রহ্মান্ডে বসবাস করি ইহার ব্যাস ৫০ কোটি যোজন বা ৪০০ কোটি মাইল [১ যোজন = ৮ মাইল]এবং এর আবরণ ব্যাসের ১ কোটি ১১ লক্ষ গুণ বেশি চওড়া এবং আবরণগুলি ৭ টি স্তরে বিভক্ত,ইহাতে আগুনের স্তর ৪০,০০০ কোটি মাইল চওড়া এভাবে অন্য আবরণগুলি বর্ণনা নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যাহা করিতে বিজ্ঞানীরা অক্ষম। চিন্ময়জগত বা বিপরীত জগত (𝕊𝕡𝕚𝕣𝕚𝕥𝕦𝕒𝕝 𝕎𝕠𝕣𝕝𝕕 𝕠𝕣 𝔸𝕟𝕥𝕚 𝕄𝕒𝕥𝕖𝕣𝕚𝕒𝕝 𝕎𝕠𝕣𝕝𝕕) ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে জড় জগত ছাড়া আরো একটি জগত আছে, সেটা হল চিন্ময়জগত । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, চিন্ময় জগত জড় জগতের চেয়ে তিন গুণ বড় । ভগবানের এক অংশে জড় জগত অথবা
বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তর্বাজুন ।
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ।। (গীতা ১০/৪২)
অনুবাদ হে অর্জুন, অধিক আর কি বলিব, এইমাত্র জানিয়া রাখ যে, আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছি । জড়জগত যদি অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডের সমান হয় তবে চিন্ময় জগত কত বড় সেটা আমাদের ধারনার বাইরে । চিন্ময় জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই, ইহা শাশ্বত নিত্য বস্তু । চিন্ময় জগত শাশ্বত
পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎসনাতনঃ ।
যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি ।। (গীতা ৮/২০)
অনুবাদ আর একটি প্রকৃতি রহিয়াছে, যাহা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত । ব্রহ্মা থেকে স্থাবর জঙ্গম আদি সমস্ত ভূত বিনষ্ট হইলেও তাহা বিনষ্ট হয় না । এই শ্লোকে চিন্ময় জগতের সুন্দর বর্ণনা করা হইয়াছে । চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ গ্রহকে বলা হয় গোলক বৃন্দাবন এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিত্য অর্থাৎ সর্বদা বর্তমান থাকেন অর্থাৎ এটা তাহার নিজের বাসস্থান বা ধাম । গোলক বৃন্দাবন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিজস্ব ধাম
আনন্দচিন্ময়রসপ্রতিভাবিতাভি-স্তাভির্য এব নিজরূপতয়াকলাভিঃ গোলক এব নিবসত্যখিলাত্মভ তো গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।। (ব্রহ্ম সংহিতা ৫/৩৭)
অনুবাদ পরমেশ্বর ভগবান, গোবিন্দ, যিনি তাঁহার সবিশেষ রূপের কিরণের দ্বারা সকলের ইন্দ্র্রিয়সমূহকে উজ্জীবিত করেন, তিনি গোলক নামক তাঁহার স্বীয় অপ্রাকৃত ধামে সর্বদা বিরাজ করেন । তথাপি তিনি তাঁহার আহ্লাদিনী-শক্তির তুল্য আনন্দময় দিব্য কিরণের প্রসারের দ্বারা তাহার সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ভগবান সর্বদা গোলক নামক অপ্রাকৃত বা চিন্ময় ধামে অবস্থান করেন । ভগবান কখনও তাঁহার নিজের ধাম ত্যাগ করিয়া কোথাও যান না । তবে যখন জড় জগতে যাওয়ার প্র্রয়োজন হয়, তখন তিনি নিজের থেকে ছায়া কৃষ্ণ তৈরী করে জড় জগতে পাঠান । ভাগবতে উল্লেখ করা হয়েছে ছায়াকৃষ্ণ এবং মূলকৃষ্ণ এক ও অভিন্ন, উভয়ের শক্তি সমান । ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে, আমরা যে জড়জগতে বাস করি সেটা হল চিন্ময় জগতের বিপরীত প্রতিফলন বা বিপরীত অবস্থা । জড় জগতের যেমন সৃষ্টি ও ধ্বংস আছে, ঠিক সেরকম চিন্ময় জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই, অর্থাৎ জড় জগতের বিপরীত অবস্থা । চিন্ময় জগত শাশ্বত, নিত্য এবং অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান । সৃষ্টিকর্তার যেমন সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই, ঠিক সেরকম চিন্ময় জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই । জন্ম, মৃত্যু, জড়াব্যাধি এই সকল বিষয় চিন্ময় জগতে নাই । চিন্ময় জগতে মানুষের বয়স বৃদ্ধি পায় না কারণ সেখানে কালের কোন প্রভাব নাই । চিন্ময় জগতে কালের প্রভাব নাই
প্রবর্ততে যত্র রজস্তমস্তয়োঃ সত্ত্বং চ মিশ্রং ন চ কালবিক্রমঃ ।
ন য্ত্র মায়া কিমুতাপরে হরে- রনুব্রতা যত্র সুরাসুরার্চিতাঃ ।। (ভাগবত ২/৯/১০)
অনুবাদ ভগবানের সেই ধামে রজো তমোগুণ নাই, এমনকি সেখানে সত্ত্বগুনেরও প্রভাব নাই । সেখানে বহিরঙ্গা মায়াশক্তির প্রভাব তো দূরের কথা, কালেরও প্রভাব নাই । মায়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারে না । সুর এবং অসুর উভয়ে কোনরম ভেদবুদ্ধি না করিয়াই ভগবানের পূজা করেন । এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, চিন্ময় জগতে কালের কোন প্রভাব নাই । কাল এক প্রকার শক্তি, এই শক্তির দ্বারা ভগবান জড় জগতসহ সবকিছু সৃষ্টি, ধ্বংস এবং নিয়ন্ত্রন করেন, কালের প্রভাবে সব কিছু পরিবর্তিত হয়, আজকের যুবক ৫০ বছর পর বৃদ্ধে পরিণত হয় কালের প্রভাবে । যেহেতু চিন্ময় জগতে কালের কোন প্রভাব নাই, তাই সেখানে সবকিছু অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে ।(বিঃ দ্রঃ – কৃষ্ণ যখন অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করছিলেন তখন কৃষ্ণের বয়স ছিল ১২৫ বছর কিন্তু তার এত বয়স সত্ত্বেও তাকে দেখা গিয়েছিল ২৫ বছরের যুবকের মত কারন ভগবান কৃষ্ণের দেহ ছিল চিন্ময় [সৎ, চিৎ, আনন্দময়]তাই তার উপর কালর প্রভাব পরে না) । চিন্ময় জগতে সব কিছু জীবন্ত যেখানে জড় বা প্রাণহীন কোন বস্তু নাই । আমরা জড় জগতে প্রানীর দেহে যে আত্মার প্রভাব অনুভব করি, সেই আত্মা জড় জগত থেকে সৃষ্টি হয় নাই । আত্মা চিন্ময় বস্তু, ইহার কোন সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই । সেজন্য ইহা চিন্ময় জগতের বস্তু অর্থাৎ আত্মা চিন্ময় জগত থেকে এই জড় জগতে এসেছে । আত্মাকে সাধারণ ভাষায় জীবন বা প্রাণ বলে । কিছু বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করিয়াছেন গভীর সমুদ্রে সূর্যলোকের প্রভাবে কতগুলি জড় বস্তুর সম্মিলনে প্রাণ বা জীবন বা আত্মা সৃষ্টি হয়েছে । আবার কেউ বলছেন পানি থেকে জীবন সৃষ্টি হয়ছে । আমাদের মনে রাখতে হবে, জড় বা প্রাণহীন বস্তু থেকে জীবন সৃষ্টি হতে পারে না । জীবন বা আত্মা হল উৎকৃষ্ট উচ্চ স্তরের বস্তু সেটা কখনও নিম্নস্তরের জড় বস্তু থেকে সৃষ্টি হতে পারে না । বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবৎ গবেষণা করছে এই মহাবিশ্বে জীবন বা আত্মা কোথা থেকে এসেছে । সেই প্রশ্নের উত্তরে ভাগবত বলিতেছে আত্মা চিন্ময় জগত থেকে এসেছে ।চিন্ময় জগতের চিন্ময় ব অপ্রাকৃত বস্তু, এর সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই চিন্ময় জগত থেকে আত্মার আগমন হয়েছে এবং চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়া ইহার মূল লক্ষ্য-এই জন্য মানব জীবনের মূল লক্ষ্য হল শ্বাশত জীবন অর্থাৎ চিন্ময় জগতে ফিরে যাওয়া। আত্মা চিন্ময় জগত থেকে আসে
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ ।। (গীতা ৭/৫)
অনুবাদ হে মহাবহো, এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রহিয়াছে । সেই প্রকৃতি চৈতন্য স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হইয়া এই জড় জগতকে ধারণ করিয়া আছে । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ভগবানের অন্য একটি উৎকৃষ্টা চৈতন্য স্বরূপা অর্থাৎ চিন্ময় জগত আছে যা জীবভূত অর্থাৎ সেখান থেকে জীবন বা আত্মা এসেছে । চিন্ময় জগতকে আলোকিত করার জন্য জড় জগতের মত সূর্যালোকের প্রয়োজন নাই । সূর্যালোকের যে উৎস ব্রহ্ম জ্যোতি, তাহার দ্বারা চিন্ময় জগত আলোকিত হয় । চিন্ময় জগতে সূর্যোলোক বা চন্দ্রালোকের প্রয়োজন নাই
ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো না শশাঙ্কো ন পাবকঃ ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ।। (গীতা ১৫/৬)
অনুবাদ আমার সেই রম ধাম সূর্য, চন্দ্র অথবা বিদুৎ আলোকিত করিতে পারে না । সেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরিয়া আসিতে হয় না । এ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে পরমধাম বা চিন্ময় জগত সূর্য, চন্দ্র বা বিদুৎ আলোকিত করতে পারে না । চিন্ময় জগতের জলও জীবন্ত বস্তুর মত ক্রিয়া করে । যেমন – ব্রহ্মা হিরণ্যকশিপুর ভক্ষিত শরীরে যখন চিন্ময় জল সিঞ্চন করেন, তখন হিরণ্যকশিপু নব যৌবন প্রাপ্ত হয় । চিন্ময় জলের প্রভাব
ইত্যুক্তৃদিভাবো দেবো ভক্ষিতাঙ্গং পিপীলিকৈঃ ।
কমন্ডলুলেনৌক্ষদ্দিব্যেনামোঘরাধসা ।। (ভাগবত ৭/৩/২২)
অনুবাদ শ্রীনারদ মুনি বললেন – হিরণ্যকশিপুকে এই কথা বলিয়া, এই ব্রহ্মান্ডের আদিদেব ব্রহ্মা তাহার কমন্ডুলু থেকে অব্যর্থ দিব্য জল নিয়া পিপীলিকা কর্তৃক ভক্ষিত হিরণ্যকশিপুর দেহে সিঞ্চন করিয়াছিলেন । তাহার ফলে হিরণ্যকশিপুর শরীর পুণরুজ্জীবিত হইয়াছিল । মানুষ উন্নত কর্মের দ্বারা চিন্ময় শরীর লাভ করতে পারে, সেই শরীর দ্বারা সে মহাশূন্য ভ্রমণ করতে পারে এবং ভগবানের সঙ্গ করার সুযোগ পায়। নারদ মুনির শরীর চিন্ময়
প্রযুজ্যমানে ময়ি তাং শুদ্ধাং ভাগবতীং তনুম্ ।
আরব্ধকর্মনির্বাণো ন্যপতৎ পাঞ্চভৌতিকঃ ।। (ভাগবত ১/৬/২৮)
অনুবাদ এই শ্লোকে নারদ মুনি তাহার জড় শরীর ত্যাগের পর চিন্ময় শরীর লাভের কথা বর্ণনা করেছেন । চিন্ময় জগতের বিপরীত প্রতিফলন এই জড় জগত বা বিশ্বব্রহ্মান্ড । আমাদের এই মহাবিশ্ব যা দ্বারা তৈরী এর বিপরীত পদার্থ দ্বারা চিন্ময় জগত তৈরী । ভগবানের জড় জগতের ধাম চিন্ময় জগতের প্রতিরূপ কৃষ্ণলোক সম্বন্ধে জীব গোস্বামী স্কন্দ পুরাণের বর্ণনার উল্লেখ করেছেন যা যথা ভুবি বর্তন্তে পুর্যো ভগবতঃ প্রিয়াঃ তাস্তথা সন্তি বৈকুন্ঠে তদ্ভল্লীলার্থমা দৃতাঃ ।। জড় জগতে দ্বারকা, মথুরা এবং গোলোক আদি ভগবানের ধামসমূহ চিৎজগতে ভগবতধামের অবিকল । সায়ম্ভূবতন্ত্রে চতুর্দশাক্ষর মন্ত্রের প্রভাব সম্বন্ধে শিব এবং পার্বতীর আলোচনায় তা প্রতিপন্ন হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে চিন্ময় জগতের নীচে জড়জগত অবস্থিত
নানাকল্পলতাকীর্ণং বৈকুন্ঠং ব্যাপকং স্মরেৎ ।
অধঃ সাম্যং গুণানাঞ্চ প্রকৃতিঃ সর্বকারণম্ ।। (চৈতন্য চরিতামৃত ১/৫/১৮)
অনুবাদ মন্ত্র জপ করিবার সময় সর্বদা চিৎজগতের কথা স্মরণ করা উচিত, যাহা অন্তহীনভাবে ব্যাপ্ত এবং সমস্ত মনোরথ পূর্ণকারী কল্পবৃক্ষে পূর্ণ । সেই বৈকুন্ঠলোকের আধোভাগে জড় সৃষ্টির কারণস্বরূপা প্রকৃতি অবস্থিতা । এখানে বর্ণনা করা হয়েছে চিন্ময় জগতের নীচে জড় জগত অবস্থিত । চিন্ময় জগত সন্মন্ধে বিজ্ঞানীদের ধারণা (ℂ𝕠𝕟𝕔𝕖𝕡𝕥 𝕠𝕗 𝕊𝕔𝕚𝕖𝕟𝕥𝕚𝕤𝕥𝕤 𝕒𝕓𝕠𝕦𝕥 𝕊𝕡𝕚𝕣𝕚𝕥𝕦𝕒𝕝 𝕎𝕠𝕣𝕝𝕕) চিন্ময় জগত বা বিপরীত জগত সন্মন্ধে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট কোন ধরনা নাই তবে চিন্ময় জগতের কিছু ইঙ্গিত বিজ্ঞানীদের বিবরণে পাওয়া যায় । ষ্টিফেন হকিং রচিত কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইটিতে তিনি বর্ণনা করেছেন । বিজ্ঞানীদের ধারনা ইলেকট্রনের নিশ্চয় একটি জুড়ি থাকবে অর্থাৎ থাকবে একটি বিপরীত ইলেকট্রন (𝔸𝕟𝕥𝕚-𝔼𝕝𝕖𝕔𝕥𝕣𝕠𝕟) কিংবা পজিট্রন । ১৯৩২ সালে পজিট্রন আবিষ্কৃত হয় । ফলে ডিরাকের তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণিত হয়, এই আবিষ্কার ১৯৩৩ সালে ডিরাকের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পথিকৃৎ । আমরা এখন জানি প্রতিটি কণিকারই একটি বিপরীত-কণিকা (𝔸𝕟𝕥𝕚-ℙ𝕒𝕣𝕥𝕚𝕔𝕝𝕖) আছে । তাহার সঙ্গে কণিকাটি বিনাশপ্রাপ্ত (𝕒𝕟𝕟𝕙𝕚𝕝𝕒𝕥𝕖𝕕) হতে পারে (বলবাহী কণাগুলির ক্ষেত্রে বিপরীত কণিকা এবং কণিকাটি অভিন্ন) । বিপরীত কণিকা দ্বারা গঠিত বিপরীত পৃথিবী এবং বিপরীত মানুষও থাকতে পারে । কিন্তু আপনার বিপরীত সত্তার সঙ্গে দেখা হলে তাহার সঙ্গে করমর্দন করবেন না । তা করিলে আলোর ঝলকে মিলাইয়া যাবেন । বিজ্ঞানীদের এ বর্ণনা থেকে ধারনা করা যায় তারা একটি বিপরীত জগতের কথা ভাবিতেছেন এবং বিপরীত পদার্থের মানুষ থাকাও সম্ভব বিজ্ঞানীদের এই ধারনা আংশিকভাবে চিন্ময় জগতকে ইঙ্গিত করে । একটি পরমাণু ইলেকট্রন (𝔼𝕝𝕖𝕔𝕥𝕣𝕠𝕟), প্রোটন (ℙ𝕣𝕠𝕥𝕠𝕟) এবং নিউট্রন (ℕ𝕖𝕦𝕥𝕣𝕠𝕟) কণিকা দ্বারা গঠিত । ২০(বিশ) বছর আগ পর্যন্ত মনে করা হত এইগুলি মৌল কণিকা । কিন্তু ১৯৬৯ সালে বিজ্ঞানী মারে গেলম্যান (𝕄𝕦𝕣𝕣𝕒𝕪 𝔾𝕖𝕝𝕝 𝕄𝕒𝕟𝕟) প্রমাণ করেন নিউট্রন এবং প্রোটন কার্ক (ℚ𝕦𝕒𝕣𝕜) নামক কণিকা দ্বারা গঠিত । প্রতিটি নিউট্রন এবং প্রোটন ৩টি করে কার্ক দ্বারা গঠিত । এ আবিষ্কারের জন্য গেলম্যান সাহেব নোবেল প্রাইজ পান । এখন পর্যন্ত কার্ককে মৌল কণা হিসাবে বিবেচনা করা হয় । অন্যান্য নীহারিকাতে পদার্থ প্রোটন এবং নিউট্রন অথবা বিপরীত প্রোটন এবং বিপরীত নিউট্রন দ্বারা গঠিত কিনা এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কোন প্রত্যক্ষ প্রমান নাই । একই নীহারিকাতে দুইয়ের মিশ্রণ থাকতে পারে না । কতগুলি নীহারিকা পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং কতগুলি নীহারিকা বিপরীত পদার্থ দিয়ে গঠিত এরকম সম্ভবনা নাই । বিপরীত কার্কের তুলনায় কার্কের সংখ্যা অত বেশী কেন ? দুইয়ের সংখ্যা এক না হওয়ার কারণ কি ? দুইয়ের সংখ্যা সমান না হওয়া আমাদের সৌভাগ্য । তাহার কারণ, সে রকম হলে সমস্ত কার্ক এবং বিপরীত কার্ক মহাবিশ্বের আদিমকালে পরস্পরকে ধ্বংস করিয়া ফেলিত । মহাবিশ্ব বিকিরণে ভর্তি থাকিত, কিন্তু বিশেষ কোন পদার্থ থাকত না । মনুষ্যজীবন বিকাশ লাভ করবার মতো কোন নীহারিকা, কোন তাঁরকা, কোন গ্রহ থাকত না । শুরুতে যদি দুইয়ের সংখ্যা সমান থাকিয়াও থাকে, তা হলে এখন কার্কের সংখ্যা এত বেশী কেন ? সৌভাগ্যক্রমে সে সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বগুলি একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে । আমরা দেখেছি উচ্চশক্তিতে কার্কের বিপরীত ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হওয়ার অনুমোদন 𝔾𝕦𝕥-এর আছে । এর বিপরীত পদ্ধতি অর্থাৎ কার্কের ইলেকট্রনের রূপান্তর এবং ইলেকট্রন বিপরীত ইলেকট্রনে রূপান্তর তাহারা অনুমোদন করে । মহাবিশ্বের অতি আদিম যুগে একটা সময় ছিল যখন মহাবিশ্ব এত উত্তপ্ত হওয়ার ফলে কণিকা শক্তি এত উচ্চমানের হত যে এই সমস্ত রূপান্তর সম্ভবপর ছিল কিন্তু তাহার ফলে কার্কের সংখ্যা বিপরীত কার্কের চাইতে বেশী হইবে কেন ? তার কারন পদার্থবিদ্যার বিধিগুলি কণিকা এবং বিপরীত কণিকার ক্ষেত্রে অভিন্ন নয় । আপনি যদি সমস্ত কণিকা এবং প্রতিকণিকার গতি বিপরীতমুখী করে দেন, তা হলে তন্ত্রটি (𝕤𝕪𝕤𝕥𝕖𝕞) অতীত কালে যা ছিল সে অবস্থায় ফিরে যাবে । অর্থাৎ বিধিগুলি কালের সম্মুখ অভিমুখে এবং পশ্চাৎ অভিমুখে একই হবে । ১৯৫৬ সালে সুং দাও লী (𝕋𝕤𝕦𝕟𝕘 𝔻𝕒𝕠 𝕃𝕖𝕖) এবং চেন নিং ইয়াং (ℂ𝕙𝕖𝕟 ℕ𝕚𝕟𝕘 𝕐𝕒𝕟𝕘) নামে দুজন আমেরিকান পদার্থবিদ প্রস্তাবনা করেন যে, আসলে দুর্বল বল (𝕨𝕖𝕒𝕜 𝕗𝕠𝕣𝕔𝕖) প্রতিসাম্য ℙ মানে না । পরের বছর লী এবং ইয়াং তাহাদের চিন্তাধারা জন্য নোবেল পুরষ্কার পান । এইও দেখা গিয়েছিল যে, দুর্বল বল প্রতিসাম্য-ℂ মেনে চলে না । অর্থাৎ এর ফলে বিপরীত কণিকা দিয়ে গঠিত মহাবিশ্বের আচরণ আমাদের মহাবিশ্বের চাইতে পৃথক হবে । আদিম মহাবিশ্ব অবশ্যই প্রতিসাম্য-𝕋 মানে না: সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয় । সময়ের অভিমুখ পশ্চাদ্ বর্তী হলে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হবে । এই আলোচনার মাধ্যমে বিজ্ঞানীর মতামত প্রকাশ করেছেন, মহাবিশ্বের বিপরীত কার্কের (𝔸𝕟𝕥𝕚 ℚ𝕦𝕒𝕣𝕜) তুলনায় কার্কের (ℚ𝕦𝕒𝕣𝕜) সংখ্যা এত বেশী কেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেছেন কার্ক এবং বিপরীত কার্কের সংখ্যা সমান হলে একে অপরকে ধ্বংস করিয়া ফেলিত, সেজন্য কার্কের সংখ্যা বেশি । আবার বিজ্ঞানী 𝔾𝕦𝕥 অনুমোদন করেছেন উচ্চ তাপমাত্রা কার্ক থেকে এন্টিকার্ক বা বিপরীত কার্ক হতে পারে এবং বিপরীত কার্ক থেকে কার্ক হতে পারে । সহজভাবে বলা যেতে পারে পদার্থ থেকে বিপরীত পদার্থ এবং বিপরীত পদার্থ থেকে পদার্থ হতে পারে । এই বিষয়টি ভাগবতে আরো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে । ভাগবতে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পরবর্তীতে মহাবিশ্ব সূষ্টি পর্বে আলোচনা করিব । (চলবে..........)
0 Response to " ২.ভাগবতের আলোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য -পর্ব ০২"
Post a Comment