শ্রীকৃষ্ণই সৃষ্টির উৎস
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীষ্মদেবকে বললেন, হে পিতামহ। যিনি সবার সৃষ্টিকর্তা, খাঁর সৃষ্টিকর্তা কেউই নেই, যাঁকে অচ্যুত, গােবিন্দ, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, কেশব, নারায়ণ প্রভৃতি নামে সংসারের লােকগণ জেনে থাকেন, সেই ভগবানের বৃত্তান্ত বিশেষরূপে কীর্তন করুন, আমি শুনতে খুবই বাসনা করি।
ভীষ্মদেব বললেন, "রাজা যুধিষ্ঠির! জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম, দেবর্ষি নারদ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের কাছে ভগবানের বৃত্তান্ত শুনেছি। মহাতপা বাল্মীকি, অসিত, দেবল ও মহর্ষি মার্কণ্ডেয়—তারা ভগবানের বিষয় অতি আতরূপে কার্জন করেছেন। তাঁরা বলেছেন পরম পুরুষ পরমেশ্বর ভগবান এক ব্যক্তি হয়েও সর্বব্যাপী। সেই পুরুষােত্তম ভগবান যাবতীয় সৃষ্টির উৎস। তাকেই সৃষ্টিকর্তা বলা হয়। তাঁর কেউ সৃষ্টিকর্তা নেই। তাকে কেউ নারায়ণ বলেন, কেউ গােবিন্দ বলেন। তিনি প্রথমে আকাশ, বায়ু, মাটি, অগ্নি, জল এই পচে মহাভুতের সৃষ্টি করে স্বয়ং জলের উপরে শয়ন করলেন। তারপর তিনি প্রথমে মনের সঙ্গে 'অহংকারের সৃষ্টি করলেন। সেই 'অহংকারের বলে সব জীবের সংসার কার্য নির্বাহ হচ্ছে। 'অহংকারের সৃষ্টির পর সেই ভগবানের নাভিদেশে অত্যন্ত উজ্জ্বল এক দিব্য পদ্ম সত হল। সেই নাভিপদ্ম থেকেই ব্রহ্মার জন্ম হল। সেই পাহাজোতিতে সর্বদিক উদ্ভাসিত হল। ব্রহ্মার আবির্ভাবের পর মধুনামে তমােণ্ডণ সম্পন্ন এক অসুর আবির্ভূত হল। সেই মধু অসুবটি ব্রহ্মার উপর অত্যাচার করতে শুরু করল। ভগবান তখন ব্রহ্মার উপকারার্থে সেই মধু অসুরতে বিনষ্ট করলেন। সেইজন্য 'ভগবানের একটি নাম হল মধুসুদন। মধু নিহত হলে ব্রহ্মার মানস পুত্রগণের উৎপত্তি হল। তারা হলেন মরীচি, অত্রি, অঙ্গি, পুলস্ত্য, পুলহ ও ক্রতু। মরীচি থেকে কশ্যপ সম্বত হন। মরীচির জন্মের পূর্বে ব্রহ্মর বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে জন্ম হল দক্ষ। দক্ষের প্রথমে ১৩টি কন্যার জন্ম হল। কড় কন্যার নাম দিতি। কশ্যপ সব কন্যার পাণি গ্রহণ করেন। তারপর দক্ষের আবার দশটি কন্যা জন্মালাে। কশ্যপের পত্নীদের থেকেই দেবতা, দৈত্য, গন্ধর্ব, গে, অশ্ব, পক্ষী, মৎস, উদ্ভিদ ইত্যাদির জন্ম হন। তারপর মধুসুদন বিবেচনা করে দিবা, রাত্রি, কাল, ঋতু, মেঘ ও ব্রহ্মাণ্ডের
যাবতীয় স্থাবর জঙ্গমের সৃষ্টি করলেন। তারপর ভগবান মধুসুদন নিজের
খ, বাহু, উরু ও পদ থেকে একশত জন করে যথাক্রমে গ্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র উৎপন্ন করলেন। চারবর্ণ সৃষ্টির বিধান করে, ব্রহ্মাকেই সর্বজীবের অধ্যক্ষ রূপে নিয়ােগ করলেন।
সেই সময় আরও অনেক কিছু বিভাগ করা হল। ইন্দ্রকে দেবতার রাজা, যমরাজকে পাপীদের নিয়ন্তা, কুবেরকে ধন রক্ষক, বরুণদেবকে জলজ’গণের অধিপতি করা হল। | হে যুধিষ্ঠির, সৃষ্টির প্রথমদিককার জীবন যাপনের কথা যা শুনেছি তাই বলি, যে ব্যক্তি যতদিন ইচ্ছা সে ততদিন জীবিত থাকতে পারত। যমের শাসনভয়ে কেউ শঙ্কিত ছিল না। স্ত্রীসংসর্গের আবশ্যকতা ছিল না। ইছা করলেই লােকে মৈথুন ছাড়াই সন্তান উৎপাদন করতে পারত। দর্শন মাত্রই সেটি সম্ভব হত। ত্রেতাযুগে লােকে কামিনীদের স্পর্শ করলেই তাদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে সমর্থ হত। দ্বাপর যুগ থেকেই মৈথুনযুগ। প্রচলিত।
হে যুধিষ্ঠির, এখন তুমি যে-সব পাপাত্মাদের দেখতে পাও যেমন অস্ত্রক, গুহ, পুলিন্দ, শবর, চুচুক, মদ্রক, যৌন, গম্বাে, গান্ধার, কিরাত ও বর্বরজাতের লােকেদের। এরা নিয়তই সারা অবনী মণ্ডলে পাপাচার করে চলেছে। এদের ব্যবহারটা কাক ও শকুনদের মতােই কদর্য। সত্যযুগে এদের নামগন্ধও ছিল না। নিতান্ত ত্রেতাযুগ থেকে ক্রমে ক্রমে এদের সংখ্যা নিতান্তই বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই পৃথিবী অসহ্য বােধ করেছে। তাই ভগবান মধুসূদন পৃথিবীর দুঃখ লাঘব করবার উদ্দেশ্যে কুরুক্ষেত্রের বিশাল যুদ্ধের আয়ােজন করেছেন এবং যােদ্ধারা পরস্পর পরস্পরকে হত্যা
| হে ধর্মরাজ! তুমি ভালাে করে জেনে রেখাে, এই মহাত্মা বাসুদেব থেকেই সবকিছু হচ্ছে। তুমি শ্রীকৃষ্ণকে সামান্য মানুষ বলে কখনাে মনে করাে না। শ্রীকৃষ্ণের মহিমা অনির্বচনীয়। (মহাভারত, শান্তিপর্ব ২০৭ অধ্যায়)
0 Response to "শ্রীকৃষ্ণই সৃষ্টির উৎস"
Post a Comment