চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
অজ্ঞতার গভীরতম অন্ধকারে আমার জন্ম হয়েছিল এবং আমার গুরুদেব জ্ঞানের আলােকবর্তিকা দিয়ে আমার চক্ষু উন্মীলিত করেছেন। তাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
শ্রীচৈতন্যমনােহভীষ্টং স্থাপিতং যেন ভূতলে।
স্বয়ং রূপঃ কদা মহং দদাতি স্বপদান্তিকম্।।
শ্রীল রূপ গােস্বামী প্রভুপাদ, যিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অভিলাষ পূর্ণ করবার জন্য এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আমি তাঁর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ কবে করতে পারব?
বন্দেহহং শ্রীগুরােঃ শ্ৰীযুতপদকমলং শ্রীগুরু বৈষ্ণবাংশ্চ
শ্রীরূপং সাগ্ৰজাতং সহগণরঘুনাথান্বিতং তং সজীব।
সাদ্বৈতং সাবধূতং পরিজন সহিতং কৃষ্ণচৈতন্যদেবং
শ্রীরাধাকৃষ্ণপাদান সহগণললিতা-শ্রীবিশাখান্বিতাংশ্চ।।
আমি আমার গুরুদেবের পাদপদ্মে ও সমস্ত বৈষ্ণববৃন্দের শ্রীচরণে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্রীরূপ গােস্বামী, তাঁর অগ্রজ শ্রীসনাতন গােস্বামী শ্রীরঘুনাথ দাস, শ্রীরঘুনাথ ভট্ট, শ্রীগোপাল ভট্ট ও শ্রীল জীব গােস্বামীর চরণকমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্রীকু যচৈতন্য, শ্রীনিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর, শ্রীবাস ও অন্যান্য পার্ষদবৃন্দের পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্ৰীমতী ললিতা ও বিশাখা সহ শ্ৰীমতী রাধারাণী ও শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।।
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে।
গােপেশ গােপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমােহস্তুতে।।
হে আমার প্রিয় কৃষ্ণ! তুমি করুণার সিন্ধু, তুমি দীনের বন্ধু, তুমি সমস্ত জগতের পতি, তুমি গােপীদের ঈশ্বর এবং শ্রীমতী রাধারাণীর প্রেমাস্পদ। আমি তােমার পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
তপ্তকাঞ্চন-গৌরাঙ্গি রাধে বৃন্দাবনেশ্বরি।
বৃষভানুসুতে দেবি প্রণমামি হরিপ্রিয়ে।।
শ্ৰীমতী রাধারাণী, যাঁর অঙ্গকান্তি তপ্তকাঞ্চনের মতে, যিনি বৃন্দাবনের ঈশ্বরী, যিনি মহারাজ বৃষভানুর দুহিতা এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী, তাব চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ।
পতিতানাং পাবনেভো বৈষ্ণবেভ্যো নমাে নমঃ।।
সমস্ত বৈষ্ণব-ভক্তবৃন্দ, যারা বাঞ্ছাকল্পতরুর মতাে সকলের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন, যারা কৃপার সাগর ও পতিতপাবন, তাদের চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
নমাে মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেমপ্রদায় তে।
কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যনাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ।।
হে মহাবদান্য অবতার! আপনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণঃ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। আপনি শ্রীমতী রাধারাণীর অঙ্গকান্তি গ্রহণ করেছেন। আপনি ব্যাপকভাবে শুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করছেন। আমরা আপনাকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি।।
যদদ্বৈতং ব্রহ্মোপনিষদি তপস্য তনু।
য আত্মান্তর্যামী পুরুষ ইতি সােহস্যাংশবিভবঃ।
যড়ৈশ্বর্যৈঃ পূর্ণো য ইহ ভগবান্ স স্বয়ময়ং
ন চৈতন্যাৎ কৃষ্ণাজ্জগতি পরতত্ত্বং পরমিহ।।
উপনিষদে যাকে নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, তা তঁার (এই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের) অঙ্গকান্তি। যােগশাস্ত্রে যােগীরা যে পুরুষকে অন্তর্যামী পরমাত্মা বলেন, তিনিও তারই (এই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের) অংশ বৈভব। তত্ত্ববিচারে যাকে ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ ভগবান্ বলা হয়, তিনিও স্বয়ং এই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যেরই অভিন্ন স্বরূপ। এই জাগতে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য থেকে ভিন্ন পরতত্ত্ব আর কিছু নেই।
রাধা কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতিত্নাদিনীশক্তিরস্মা
দেকাত্মানাবপি ভুৰি পুরা দেহভেদং গতে তেী।
চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপ।
শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়ের বিকার-স্বরূপা; সুতরাং শ্রীমতী রাধারাণী শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। এজন্য তারা (শ্রীমতী রাধারাণী ও শ্রীকৃষ্ণ) একাত্মা। কিন্তু একাত্ম হলেও তারা অনাদিকাল থেকে গােলােকে পৃথক দেহ ধারণ করে আছেন। এখন (কলিযুগে) সেই দুই দেহ পুনরায় একত্রে যুক্ত হয়ে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে প্রকট হয়েছেন। শ্রীমতী রাধারাণীর এই ভাব ও কান্তিযুক্ত শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যকে আমি আমার প্রণতি নিবেদন করি।
চিরাদদত্তং নিজগুপ্তবিং স্বপ্রেম নামামৃতমত্যুদারঃ।
আপামরং যাে বিততার গৌর কৃষ্ণো জনেভ্যস্তমহং প্রপদ্য।।
চৈ, চ. ম. ২৩/১) তার প্রেম-নাম-অমৃত-রূপ গুপ্ত বিত্ত, যা এর আগে আর কাউকে দেওয়া হয়নি, তাই অতি উদার স্বভাব যে গৌরসুন্দর সবচাইতে নিম্নস্তরের মানুষদের পর্যন্ত বিতরণ করেছিলেন, তাঁকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।।
গৌরঃ সচ্চরিতামৃতামৃতনিধিঃ গৌরং সদৈব-স্তুবে,
গৌৱেণ প্রথিতং রহস্য-ভজনং গৌরায় সর্বং দদে।
গৌরাদস্তি কৃপালু রত্র ন পরে গেরস্য ভৃত্যো ভবং,
গৌরে গৌরবমাচরামি ভগবন্ গেীর-প্রভাে রক্ষ মাং।।
গৌর, সচ্চরিতামৃত সমুদ্র। আমি সর্বদাই গৌরের স্তব করি। গৌর কর্তৃক গােপী আনুগত্যের রহস্য ভজন বিস্তারিত হয়েছে। গেীরকেই আমি সর্বস্ব দান করব। ধরণীতে গেীর বাতীত অধিকতর কৃপালু আর কেউ নেই। আমি গেীরের ভূত হব, গৌরের গৌরব ভক্তি বিধান করব। হে চিরসুন্দর প্রভাে গেীর। আমাকে সেবা দান করে, রক্ষা করুন।
মাধুযৈঃ-মধুভি সুগম্ভিভজন স্বর্ণদ্ভুজানাং বনম্
কারণ্যামৃত নিঝরৈরূপচিতঃ সৎ-প্রেম হেমাচলঃ।
ভক্তম্ভোধর-ধরণী বিজয়নী নিস্কম্প সম্পাবলী
দৈৰৰ ন কুল দৈবতা বিজয়তাং চৈতন্য-কৃষ্ণ-হরিঃ।।
শ্রবণ-কমল বনে মাধুর্যমণ্ডিত সুগভীর ভজন মধুরিমা-দ্বারা প্রস্ফুটিত, সংপ্রেম বিভূষিত রূপরাশি বিকচিত অত্যঙ্গ হেমশিখর হতে কারুণ্যামৃতরূপ নিরধারা প্রবাহিত করে, ভণ-কষ্ঠোচ্চারিত জয়ধ্বনিতে চরাচর ধরণীতে অবিচলিত প্রেমসম্পদাবলী-সহিত যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তিনি সর্বদেবারাধ্য শ্রীকৃষ্ণই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, কলিকল্মষ-হরণকারী শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য হরি পরিপূর্ণরূপে জয়যুক্ত হােন্।
আজানুলখিতভুজেী কনকাবদাতে
সঙ্কীর্থনৈক পিতরেী কমলায়তক্ষেী।
বিশ্বম্ভলো দ্বিজবজ্ঞেয়ী যুগধর্মপালেী। |
বন্দে জগৎ প্রিয়কৱেী করুণাৰতারে।।
চৈতন্য ভাগবত-১/১)। |
যাদের বাহুদ্বয় হাঁটু পর্যন্ত প্রসারিত, দেহ স্বাভ উজ্জ্বল জ্যোতি বিক্ষাকারী, চক্ষু গদ্মফুলের পাপড়ির মতােই বিস্তৃত, যারা ব্রাহ্মণদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, যুগধর্মের পালক, বিশ্বের মহান ভরণপােষণকারী, ভগবানের মহাবদান্য পরম করুণাময় অবতার ও খারা হরিনাম সংকীর্তন যজ্ঞের প্রবর্তক—সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে আমি কন্দনা করি।
অনৰ্পিতীং চিরাৎ কণয়াৰতীর্ণয় কলো।
সমপমিতুমুয়াতোলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়।।
হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ।
সদা হৃদয়কন্দরে ক্ষুরতু বঃ শচীনন্দনঃ।।
চৈ. চ. আ. ১/৪, বিদগ্ধ মাধব-১/২)
পূর্বে যা অর্পিত হয়নি, উন্নত ও উজ্জ্বল রসময়ী নিজের সেই ভক্তি-সম্পদ দান করার জন্য যিনি করুণাবশত কলিযুগে অবতীর্ণ হয়েছেন, স্বর্ণ থেকেও সুন্দর দ্যুতিসমূহ থাকা সমুস্তাসিত সেই শচীনন্দন শ্রীহরি সর্বদা তােমাদের হৃদয়করে ফুরিত হােন্।
নিম্নলিখিত তিনটি পদ শ্রীল নরােত্তম দাস ঠাকুরের “শ্রীশীপ্রেম-ভক্তিচন্দ্রিকায় অন্তর্গত ১০ম গীতের ১২-১৪ নং স্তবক।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব, রতি মতি ভাবে ভজ
প্রেম কল্পতরু বরদাতা। |
শ্রীব্রজরাজনন্দন, রাধিকাজীবনধন,
অপরূপ এই সব কথা।।
ওহে ভাই, সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের চরণে রতি মতি রেখে তার ভজন কর। তিনি স্বয়ং প্রেমকল্পতরু এবং স্বীয় অচিন্ত্যশক্তিতে সেই প্রেম-কল্পতরুর মালী হয়ে প্রেমফল প্রদান করছেন। তিনি শ্রীব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীরাধার প্রাণনাথ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই। এ সব অতি অদ্ভুত কথা।
নবদ্বীপে অবতরি, রাধাভাৰ অঙ্গীকরি,
তার কান্তি অঙ্গের ভূষণ।
তিন বাঞ্ছা অভিলাষী, শচীগর্ভে পরকাশি,
সঙ্গে লঞা পারিষদগণ।।
শ্রীরাধিকার প্রাণনাথ ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার ভাব অঙ্গীকার করে এবং তার ভাবকান্তিকে অঙ্গের ভূষণ করে শ্রীগৌরাঙ্গরূপে নবদ্বীপে অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনটি বিষয়ে লােভবশতঃ শ্রীরাধার ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র শচীগৰ্ভসিন্ধুতে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি যখন এ ভাবে আবির্ভূত হলেন তখন তার পার্ষদেরাও তাকে অনুসরণ করে এ ধরনীতে আবির্ভূত হলেন।
0 Response to "মঙ্গলাচরণ"
Post a Comment